প্রণবেশ মাইতি
(জন্ম ১৯৫৮ সালে , পশ্চিমবঙ্গের মেদিনীপুর জেলায় )
শিল্পী সম্বন্ধে অভিজ্ঞতা অর্জন করতে গিয়ে প্রথমেই বলাবাহুল্য প্রণবেশ মাইতি শুধু ছবি ই আঁকেননি, অন্যের ছবি সংগ্রহ করেছেন এবং বিশেষ ভাবে পূর্বজ শিল্পীদের কথা পরবর্তী প্রজন্মকে মনে করিয়েছেন।ছবি বলতে শুধুমাত্র ফাইন আর্টস কেই তিনি বুঝতে চান নি। ফাইন আর্টস থেকে বেরিয়ে এসে কমার্শিয়াল আর্ট এর জগতে নিজের ব্যাপ্তি প্রকাশ করেছেন।বাংলা কমার্শিয়াল আর্ট কতরকম ভাবে তার রুপসৃজন করতে পারে তা প্রণবেশ মাইতির সান্নিধ্য লাভে টের পাওয়া যায়। অশীতিপর একজন শিল্পী যিনি সৃজনশীল বানিজ্যিক শিল্প কলাকে তাঁর শিল্প সম্ভার দিয়ে সমৃদ্ধ করে তুলেছেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য ভাবে করা প্রচ্ছদ এর নকশা, অলংকরণ এবং চিত্রন গুলো অত্যন্ত প্রশংসিত।

স্কুল জীবনে ই শিল্পের প্রতি তাঁর অনুরাগ এবং এই বিষয়ে ই পারদর্শীতার পরিচয় পাওয়া যায়। ফলতঃ ১৯৫৮ সাল নাগাদ তিনি কলকাতায় সরকারি চারু ও কারুকলা মহাবিদ্যালয়ে কমার্শিয়াল আর্ট এর ছাত্র হিসেবে শিল্পী জীবনের সূচনা করেছিলেন। পারিবারিক ক্ষেত্রে বাবা কাকা জ্যাঠারা আইনজীবী হলেও, তিনি সেখান থেকে বেরিয়ে এসে আর্ট কলেজের গন্ডি তে পদার্পণ করলেন,শুধু মাত্র এই লক্ষ্যে, নিজেকে ড্রাফ্টম্যান হিসেবেই প্রতিষ্ঠিত করতে হবে।
কলেজ জীবনের পরিবেশ শিল্পীর জীবনে যেমন আত্মবিশ্বাস এনে দেয় তেমনি সৃজন ধর্মী শিল্প সৃষ্টি বোধের চেতনাকেও দৃঢ় করে তোলে।সেই সময় সরকারি চারু ও কারুকলা মহাবিদ্যালয়ের প্রিন্সিপাল ছিলেন শিল্পী চিন্তা মণি কর। তাছাড়া ও শিক্ষক হিসেবে পেয়েছিলেন, শিল্পী গোপাল ঘোষ কে। যার বিশেষ শিক্ষা পদ্ধতি শিল্পীর জীবনে অনেক টাই প্রভাব ফেলেছিল। পাশাপাশি ছিলেন রথীন মৈত্র, কিশোরী রায়, ভাস্কর সুনীল পাল,মাখন দত্তগুপ্ত,হরেন দাস,অনিল কৃষ্ণ ভট্টাচার্য (আলফা বিটা) দেব কুমার চৌধুরী, জগদীশ রায় প্রমুখ। সময়ের ব্যবধানে ছাত্র জীবনে অভিজ্ঞতা বৃদ্ধি পাওয়ার পাশাপাশি শিল্পীর জীবনের লক্ষ্য স্থির হতে থাকে। সুতরাং তিনি ব্যবহারিক শিল্পকলা বিভাগেই তাঁর ভবিষ্যৎ শিল্পী জীবনকে নিশ্চিৎ করে ফেলেছিলেন।

সেই সময়ে কমার্শিয়াল বিভাগের প্রধান ছিলেন মাখন দত্তগুপ্ত। তারপর আসেন জগদীশ রায়। শিল্পীর ছাত্র জীবনে তাঁদের অবদান ছিল প্রচুর। ছাত্র জীবনের চতুর্থ বর্ষে শিল্পী যোগাযোগ পেলেন ইনস্টিটিউট অফ চিলড্রেন ফিল্মের। পরিচিতি লাভ করলেন রঘুনাথ গোস্বামী,শৈল চক্রবর্তী, রেবতী ভূষণ, পূর্ণেন্দু পত্রী,দেবব্রত মুখোপাধ্যায় এর মতো প্রভাবশালী গুণী শিল্পীদের সঙ্গে।
শিল্পী প্রণবেশ মাইতির চাকুরি জীবনের আরম্ভ হয়েছিল আহমেদাবাদে ক্যালিকো টেক্সটাইল দিয়ে। এবং পরবর্তী সময়ে চলে আসেন বোম্বে তে (বর্তমান মুম্বাই)। সেখানে তিনি বোম্বে টাইমস্ অফ ইন্ডিয়া তে একপ্রকার ফ্রিল্যান্সিং এর চাকরিতে নিযুক্ত হলেন তাঁর ই সহপাঠী শিল্পী পৃথ্বিশ গঙ্গোপাধ্যায়ের সুপারিশ এ। বলাবাহুল্য ইতি মধ্যে ই ১৯৭৩ এ তিনি তাঁর সহপাঠীনি নীলিমা মুখার্জি(ইন্ডিয়ান স্টাইল পেইন্টিং এর ছাত্রী ছিলেন)কে বিবাহ করলেন।
বোম্বে তে টাইমস্ অফ ইন্ডিয়ার কাজের সূত্রে প্রণবেশ মাইতি শিল্পী চিত্তপ্রসাদের সান্নিধ্য লাভ করলেন এবং পরবর্তী সময়ে এই সান্নিধ্য শিল্পীর শিল্প ভাবনায় এক বিশেষ আলোড়ন জাগিয়ে তুলতে সাহায্য করে। অতি শিঘ্রই তিনি কলকাতায় ফিরে আসেন এবং কলকাতা পোর্ট ট্রাস্টের ট্রেজারার পদে নিযুক্ত হন এবং বাটার বিজ্ঞাপনে তাঁর বন্ধু পৃথ্বীশ গঙ্গোপাধ্যায় এর
সহকর্মী হিসেবে কাজ শুরু করেন।
এই চাকরি জীবনের অবসর সময় টুকু কে উপযুক্ত সদ ব্যাবহার করে শিল্পী প্রণবেশ মাইতি শুরু করলেন বাংলা প্রচ্ছদ রূপায়ণ এর কাজ। বিশেষ দ্রষ্টব্য সেই সময়ে এক নতুন আন্দোলন শুরু হয় যা শাস্ত্র বিরোধী সাহিত্য আন্দোলন নামে পরিচিত।এই শাস্ত্র বিরোধী সাহিত্য গোষ্ঠীর সাহিত্যের নতুন ভাষা খুঁজতে ব্যস্ত।এই গোষ্ঠীর কাগজের নাম ' এই দশক '। শাস্ত্র বিরোধী সাহিত্য গোষ্ঠীর আড্ডায় শিল্পী প্রণবেশ মাইতি শিল্পী বলরাম বসাক, সুনীল জানা,যজ্ঞেশর রায়,রমানাথ রায়,কল্যাণ সেন, প্রমুখের সান্নিধ্যে আসেন এবং বিভিন্ন পত্র পত্রিকার সঙ্গে সংযোগ স্থাপিত হয়।৭০ দশকে শিল্পী শুরু করেন প্রচ্ছদ রচনার ভার। প্রথমেই শুরু হয় লিনো কাট দিয়ে। বিভিন্ন সাহিত্যের প্রচ্ছদের পাশাপাশি লিটল ম্যাগাজিনেও শুরু করেন লিনো কাট করে প্রচ্ছদ অলংকরণ। বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য বলরাম বসাকের পিঁপড়ে হাতি। এই বইটির ভেতরের ইলাস্ট্রেশন করলেন। প্রচ্ছদ টি করেছিলেন জিঙ্ক ব্লকে। বলাবাহুল্য ঠিক সেই সময়ে ই শিল্পী পূর্ণেন্দু পত্রীর সঙ্গে সংযোগ স্থাপন হয় ফলতঃ সেই সূত্রে একেরপর এক আনন্দমেলা, আনন্দবাজার পত্রিকার রবিবাসরে প্রচুর অলংকরণের কাজ করতে শুরু করেছিলেন। সময়ের ব্যবধানে বেঙ্গল পাবলিশার্স,ডি এম লাইব্রেরি, বাণী শিল্প,প্রতিক্ষন, আজকাল, আনন্দ পাবলিশার্স,দেজ, এশিয়া পাবলিকেশন্স,ন্যাশানাল বুক ট্রাস্ট, ইত্যাদি পাবলিকেশন্স হাউজের সাথে কাজ করতে শুরু করলেন।ঐ সময়ে পূর্ণেন্দু পত্রী ছাড়া ও সত্যজিৎ রায়, সুবোধ দাশগুপ্ত, রঘুনাথ গোস্বামীর সান্নিধ্যে ও আসেন। ক্রমশঃ বিভিন্ন দেশ বিদেশের শিল্পীর প্রচ্ছদ অলংকরণ এবং তার বিভিন্ন পদ্ধতি তে করা কাজ নিয়ে শিল্পী নিজস্ব চর্চা শুরু করেন ও ধীরে ধীরে নিজস্ব একটা স্টাইল কে রপ্ত করে ফেললেন। উল্লেখযোগ্য ভাবে দেখতে পাওয়া যায় পেপার কাটিং এর বিশেষ পদ্ধতিকে কাজে লাগিয়ে শিল্পী তাঁর চমৎকার একটি নিজস্ব স্টাইলের নিদর্শন স্থাপন করলেন।

শিল্পী প্রণবেশ মাইতি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রিন্টিং ইন্জিনিয়ারিংবিভাগের গেস্ট লেকচারার হিসেবে নিযুক্ত হলেন ১৯৮০ এর দশকে। তাছাড়াও শিল্পী কিছু বই, এবং বিভিন্ন ম্যাগাজিনে প্রবন্ধ লিখেছেন। নন্দন ৪ এ সত্যজিৎ রায় কে নিয়ে একটি প্রদর্শনীও কিউরেট করেছিলেন।২০০৫ এ একাডেমি অফ ফাইন আর্টস এ ইনভিটেশন কার্ড নিয়ে প্রদর্শনী করলেন।যার নামকরণ এবং বিষয় বস্তু উভয় ই ছিল - ' পত্র দ্বারা নিমন্ত্রণের ত্রুটি মার্জনীয় '।এটির প্রযোজক ছিলেন 'দোয়েল'এর অণিমা বিশ্বাস।এই প্রদর্শনী তে শিল্পী জন্ম থেকে মৃত্যু অবধি মানুষের জীবনের নানা পর্যায় কে কেন্দ্র করে যে সব অনুষ্ঠান হয়ে থাকে তার ই আমন্ত্রণ পত্রের নমুনা রেখেছিলেন। অধিকাংশ নিমন্ত্র পত্র গুলিই ছিল বিভিন্ন ভাবে সংগ্ৰহ করা , আত্মীয় স্বজন, বন্ধু বান্ধবের কাছ থেকে পাওয়া।

শিল্পী প্রণবেশ মাইতি তাঁর প্রচ্ছদ অলংকরণ এবং বুক ইলাস্ট্রেশন এর পাশাপাশি বিভিন্ন মাধ্যমে বাংলা শিল্পের ইতিহাস কে সংরক্ষণ করেছেন,এক ইতিবৃত্ত রচনা করেছেন। বাঙালি এই শিল্পীর নিকট চির কৃতজ্ঞ থাকবে। ২০২৪ এ পশ্চিমবঙ্গ চারু ও তথ্য কেন্দ্র বিভাগ শিল্পী প্রণবেশ মাইতি কে মনোজ মোহন বসু স্মৃতি পুরস্কার দিয়ে সন্মানিত করেছে। অশীতিপর শিল্পী প্রণবেশ মাইতি এখনও নিজস্ব আঙ্গিকে কাজ করে চলছেন। আমরা সকলেই তাঁর সুস্থতা এবং আরো অনেক টা সময় যেন তাঁর সান্নিধ্যে থাকতে পারি এই কামনা করি।
১৩/০৩/২০২৪
মৌমিতা সরকার
ফ্রিল্যান্স কিউরেটর/
মাল্টি ডিসিপ্লিনারি আর্ট প্র্যাকটিশনার